জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন থানায় ও আদালতে। এসব মামলায় ব্যক্তিগত আক্রোশ, মোটা টাকার দাবিসহ কারণে-অকারণে লোকদের আসামি করা হয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েও নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নিরীহ লোকদেরও আসামি করা হয়েছে।
শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মোটা চাঁদা না পেয়ে তাদেরও আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, মিথ্যা মামলা যারা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে; ফৌজদারি মামলা করা হবে। পুলিশের কয়েকটি ইউনিট তদন্ত করে মিথ্যা মামলার বাদীদের শনাক্ত করছে।
প্রাথমিকভাবে ৬৭ জন বাদীকে তারা শনাক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এ ধরনের মামলা থেকে রেহাই দিতে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে সরকার।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারা অনুযায়ী ইতিমধ্যে ১৩৬ জনকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
আরও ২৩৬ জনের আবেদন বিবেচনা করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় কাউকে হয়রানি করা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। যারা প্রকৃত আসামি তাদেরও আমরা চিহ্নিত করছি। তদন্তকারী কর্মকর্তা বা অন্য কেউ মামলাবাণিজ্য করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, ‘সবখানেই ভালো-মন্দ লোক আছে। কেউ ফেরেশতা নয়। পুলিশের লোক জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সাধারণ লোকের করা মামলাতেই মানুষ অতিষ্ঠ। পুলিশও জড়ালে মানুষ যাবে কোথায়?’
সারা দেশে ১৭৬০টি মামলা : সংশ্লিষ্টরা জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ সারা দেশে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭৬০টি। তার মধ্যে হত্যা মামলা ৭৬৬টি ও অন্যান্য ধারার মামলা ৯৭৪টি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৫৫টিতে। ১৮টি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৯৪১ জনকে। আসামিদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা রয়েছেন। তাছাড়া ৩৭টি মামলায় ২ হাজার ১৮৫ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। চার্জশিট দেওয়া ১৮টি হত্যা মামলা ঢাকা, চট্টগ্রাম, শেরপুর, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালী, পাবনা, কুড়িগ্রাম, বগুড়া ও আরএমপিতে হয়েছে। অন্যান্য ধারার ৩৭টি মামলা বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নরসিংদী ও বরগুনা জেলায় হয়েছে। শুধু এসআই বা ইন্সপেক্টররাই এসবের তদন্ত করছেন না, সিনিয়র কর্মকর্তারাও করছেন। কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা মামলাগুলোর মনিটরিং করছেন।
বাদী-পুলিশ যোগসাজশ! অভিযোগ উঠেছে, এখনো নানাভাবে টার্গেট করে হয়রানিমূলক মামলা করা হচ্ছে। মাঠের পুলিশ বাদীদের সঙ্গে যোগসাজশে আসামিদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে ও বাণিজ্য করছে। বিএনপি নেতাকে যুবলীগ নেতা বানিয়ে মামলা করা হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের টার্গেট করে মামলা করা হচ্ছে, মামলার ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে। দিশেহারা নির্দোষ ব্যক্তিরা টাকা ঢালতে বাধ্য হচ্ছেন। মিথ্যা মামলায় পুলিশ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
ব্যবসায়ীরা আসামি : শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীদের আসামি করা হয়েছে। এজাহারে নাম অন্তর্ভুক্ত করার আগে তাদের কাছে মোটা টাকা দাবি করা হয়। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। প্রতারকরা ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে একটি বাসায় নিয়ে দেনদরবার করে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে তারা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা না পেয়ে আদালতের মাধ্যমে তিনটি থানায় মামলা করে। অথচ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির মালিক কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এভাবে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। অনেকে বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না। যারা বিগত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেনি, তারাও হয়রানির শিকার হচ্ছে।