সূত্রমতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে (২০১২ থেকে ২০২২ সাল) বেবিচকে ৪৭ জন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের অনেকের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। আবার কারও নেই বৈধ লাইসেন্স বা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা। অপরদিকে বেশির ভাগ পরামর্শকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় ৭ মাস আগে। তবুও তারা বহাল তবিয়তে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিমানের ইন্সপেকশন, পাইলটদের লাইসেন্স নবায়ন, চেক রাইড ও সার্টিফিকেশন অনুমোদন ও মেডিকেল চেকআপের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশনস (এফএসআর) শাখায় বিশেষ পরিদর্শক, সিনিয়র অপারেশনস ইন্সপেক্টর, এভিয়েশন সেফটি, কেবিন সেফটি, ডিসপ্যাচ, লিগ্যাল ও মেডিকেল বিভাগে এসব পরামর্শকরা নিয়োজিত। বিষয়টি সামনে আসে বিশেষ পরিদর্শক (অপারেশন-পিইএল) নওরিদ ইসলাম আতোশিকে ঘিরে। তিনি গত বছরের নভেম্বরে বিদেশে পাড়ি জমালেও চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ভাতা গ্রহণ করেছেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও ভাতা নেওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নওরিদ ইসলাম আতোশি যুগান্তরকে বলেন, আমার অ্যাকাউন্টে বেতনের যে টাকা এসেছিল আমি তা ফেরত দিয়ে দিয়েছি।
জানা গেছে, বিশেষ পরিদর্শক (জ্যেষ্ঠ এফওআই) এনআইএম ফিরদাউস হোসাইন, ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ মিয়া, বিশেষ পরিদর্শক (ফ্লাইট ডিসপ্যাচ) গোবিন্দ্র চন্দ্র বাড়ই, বিশেষ পরিদর্শক (এয়ারওয়ার্দিনেস) এএফএম তারিক সিরাজ, বিশেষ পরিদর্শক (ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ রেটার) একেএম রেজাউল করিম, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিকেল অ্যাসেসর) মো. আব্দুল খালেক, সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর পাইলট রফিউল হক, সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন ফারিদুজ্জামান, সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন আজিজ আব্বাসি রফিক, গ্রুপ ক্যাপ্টেন আশরাফুল আজহার, লিগ্যাল কনসালট্যান্ট শুভ্র দে, এভিয়েশন মেডিকেল পরামর্শক ড. আশরাফুল হক, এভিয়েশন মেডিকেল এক্সামিনার ড. মঈনুদ্দিন আহমেদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
বেবিচকে কর্মরত অবৈধ পরামর্শকদের মাধ্যমে যেসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-পাইলটদের লাইসেন্স নবায়ন, চেক রাইড এবং সার্টিফিকেশন অনুমোদন। এগুলো সরাসরি উড়োজাহাজের নিরাপত্তা ও যাত্রী সাধারণের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত। বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, আইকাওর নিয়ম অনুযায়ী, এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুধু যোগ্য ও বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিদর্শকদের দিয়ে সম্পন্ন হতে হবে। অযোগ্য ও অবৈধদের দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনা আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনের (আইকাও) নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন।
সিভিল এভিয়েশনের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, যাদের নিয়োগ অবৈধ হয়ে যাওয়ায় তাদের দেওয়া লাইসেন্স বা সার্টিফিকেশনের বৈধতা নিয়েও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যদি তাদের সময়কালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের সঙ্গে কোনো বৈধ চুক্তিই নেই। এছাড়া আইকাওর তদন্তে এই অনিয়ম ধরা পড়লে বাংলাদেশকে ‘সেফটি কনসার্ন’ মতো আন্তর্জাতিক শাস্তির মুখোমুখি ফেলতে পারে। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক, বিশেষ পরিদর্শক ও আইনজীবী নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রমে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ বিভাগ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণের নির্দেশনা দেয়।
এসব পরামর্শক চুক্তি অনুযায়ী মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা গ্রহণ করেন। এছাড়া সরকারি আদেশ অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কাজের জন্য বিদেশে যাত্রা করলে তারা ভাতা পান। অভিযোগ রয়েছে, চুক্তির বাইরে তারা বিভিন্ন এয়ারলাইন্স থেকে বিশেষ অনৈতিক সুবিধাও নিয়ে থাকেন, যার মধ্যে পরিবারসহ বিদেশ ভ্রমণের এয়ার টিকিটসহ বিভিন্ন প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এদিকে, বেবিচকের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জিনিয়া জিন্নাতের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি যুগান্তরের হাতে এসেছে।
বেবিচকের চারজন চুক্তিভিত্তিক পরামর্শক, বিশেষ পরিদর্শক ও আইনজীবীর চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক উল্লেখ করে সম্প্রতি ওই চিঠি বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ বিভাগের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বেবিচকের চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, উপদেষ্টা, পরামর্শক, বিশেষ পরিদর্শক, আইনজীবী ও এজেন্ট নিয়োগ দিতে হলে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা মেনে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। অনুসরণ করতে হবে ২০০৬ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন এবং ২০০৮ সালের বিধিমালা। এই নির্দেশনা জারির ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পরামর্শকরাই এখনো সব কিছুতে প্রভাব বিস্তার করছেন। তারা বেতন পাচ্ছেন না। অথচ নিয়ন্ত্রণ করছেন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, অনুমোদন আর সিদ্ধান্ত। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে কোনো পক্ষের যেগসাজশে তারা এভাবে বহাল থাকতে পারেন- ধারণা এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের।
একজন পরামর্শক বলেন, আমাদের চুক্তি শেষ হলেও আমরা বসে নেই। বেতন না পেলেও কাজ করছি। সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন আজিজ আব্বাসি রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও তিনি রেসপন্স করেননি। আরেকজন পরামর্শক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। আপনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কিভাবে নিয়মিত অফিস করছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ অফিস করছে না। পরে তাকে নিয়মিত অফিস করার প্রমাণ দেখালে তিনি কিছু না বলে কল কেটে দেন।
ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন (এফএসআর) বিভাগের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মনিরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানোর পর বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মো. মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চুক্তি শেষ হওয়া পরামর্শকদের দিয়ে কাজ চলানো আইনগতভাবে কমপ্লায়েন্ট নয়। এমন অনিয়ম বিমান নিরাপত্তার জন্য সরাসরি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। তবে চুক্তি ও বেতন ছাড়া তাদের কাজে লাগানো প্রশাসনিক ও মানবিকভাবে অনুচিত। এই পরিস্থিতি আইকাওর রেগুলেশন লঙ্ঘনের সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা যাত্রী নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। আইকাওর অডিটে ধরা পড়লে এটি সিগনিফিক্যান্ট সেফটি রিস্ক হিসাবে বিবেচিত হবে এবং আইকাও সিগনিফিক্যান্ট সেফটি কনসার্ন (এসএসসি) সতর্কতা জারি করতে পারে। তাই বেবিচকের বর্তমান প্রশাসনের জন্য রেগুলারাইজেশন এবং চুক্তি নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে আইন ও সেফটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় থাকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কিভাবে তারা অফিস করছেন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এটা খতিয়ে দেখা দরকার। এর পেছনে স্পষ্ট কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। অন্যথায় তারা বিনা পারিশ্রমিকে কেন কাজ করবেন। বিষয়টি শুধু বেবিচকের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই নয়, আকাশপথে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারও প্রশ্ন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক রুটে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আন্তর্জাতিক রুটে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।
বেবিচকের সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন্স) গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মুকিত-উল-আলম মিঞা যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।